সন্তানকে মানুষ করা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন একটি কাজ। সন্তানকে সফলভাবে মানুষ করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো রেসিপি আজো আবিষ্কার হয়নি। তবে সাইকোলজিক্যাল রিসার্চ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা গেছে, যেগুলো সন্তানের জীবনে সফলতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

বিভিন্ন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, সফল সন্তানের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকে তার বাবা-মায়ের। অধিকাংশ সফল সন্তানদের বাবা-মায়ের মাঝে কিছু সাধারণ গুণাবলী লক্ষ্য করা গেছে।

সন্তানকে দিয়ে তারা ঘরোয়া কাজ করান

সন্তানকে দিয়ে টুকিটাকি ঘরোয়া কাজ করানো উচিত। খাওয়ার পর নিজের প্লেট নিজে ধোয়া, নিজের কাপড় নিজে পরিষ্কার করার মতো কাজগুলো সন্তানকে করতে দেওয়া উচিত। এতে তারা ছোট থেকেই ‘কাজ’ সম্পর্কে জানবে এবং কীভাবে কাজটা শেষ করতে হয়, সবকিছু গুছিয়ে নিতে হয় তা অনুধাবন করতে পারবে। তারা বুঝতে কাজ জীবনের একটি অংশ।

এই অনুধাবন তাদের পরবর্তী জীবনে এমনকি পেশাগত জীবনে সফলতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করবে। সফল সন্তানের বাবা-মায়েরা সন্তানকে দিয়ে ছোটবেলা থেকেই ঘরোয়া কাজ করিয়ে থাকেন।

সন্তানকে তারা সামাজিকভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলেন

বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব শিশু মিশুক স্বভাবের ছিল, তারা পরবর্তীতে কর্মজীবনে গিয়ে সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। সন্তানকে মিশুক হিসেবে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। অন্য বাচ্চাদের সাথে মিলেমিশে থাকা, কোনো সমস্যায় সাবলীলভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি করা, অন্যের আবেগ বুঝতে পারা ইত্যাদি গুণাবলী ছোটবেলায় যাদের মাঝে ছিল, পরবর্তীতে তারা জীবনে সফলতার দেখা পেয়েছে।

অন্যদিকে দেখা গেছে যেসব সন্তান চুপচাপ, আত্মকেন্দ্রিক, অসামাজিক ছিল তাদের অধিকাংশই পরবর্তী জীবনে মাদকাসক্ত হয়েছে, জেলে গিয়েছে এবং জর্জরিত হয়েছে বিভিন্ন সমস্যায়।

তারা উচ্চাশা রাখেন

আমেরিকায় ২০০১ সালে জন্ম নেয়া ৬,৬০০ শিশুকে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে প্রফেসর নিল হ্যাফন জানান, উচ্চাশাসম্পন্ন বাবা-মায়ের সন্তানদের সফলতার হারটা বেশ লক্ষণীয়। কারণ যেসব বাবা-মায়ের উচ্চাশা থাকে তারা সন্তানের কলেজ জীবন থেকেই ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করেন এবং সন্তানকে সেভাবে চলার পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দেন।

তারা একসাথে সংসার করেন

গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে তাদের সন্তানদের চেয়ে একত্রে থাকা বাবা-মায়ের সন্তানরা বেশি সফল হয়ে থাকে।

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ পরবর্তী দিনগুলো সন্তানের ওপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে সন্তান মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তারা কষ্ট পায়। যা একটি সফল ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে অনেক বড় বাধা। আরেকটি গবেষণায় জানা যায়, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হওয়ার ১০ বছর পরেও সন্তানরা সেই কষ্ট পুরোপুরি ভুলে যেতে পারে না।

দাম্পত্য কলহের সমাধান তারা সন্তানের সামনেই করেন

বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া হওয়ার দৃশ্য সন্তান দেখে ফেললে তার খারাপ লাগে, সে ভয় পায়। কিন্তু এই ভয়টা দূর হয়ে যায় যদি বাবা-মা সন্তানের সামনেই তাদের সমস্যার ব্যাপারে ঠাণ্ডা মাথায় আলোচনা করে একটি সমাধানে পৌঁছান।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আড়ালে সমাধান করার চেয়ে সন্তানের সামনে সমস্যার সমাধান করা উত্তম। এতে সন্তান বুঝতে পারে তার বাবা-মা ঠাণ্ডা মাথায় সমস্যার সমাধান করতে জানে। এবং সে নিজেও এই গুণ আয়ত্ব করতে উৎসাহী হয়। এই গুণ সন্তানকে তার পরবর্তী জীবনে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক সহায়তা করে।

তারা উচ্চশিক্ষিত হয়ে থাকেন

সন্তানের যখন ৮ বছর বয়স তখন বাবা-মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা কতটুকু, তা সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনে সফলতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে গবেষণায় জানা গেছে। ১৮ বা তারচেয়েও কমবয়সে মা হওয়া নারীদের সন্তানরা সাধারণত উচ্চশিক্ষিত হয় না। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্কা ও উচ্চশিক্ষিতা নারীদের সন্তান উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয় এবং কর্মজীবনে সফলতা অর্জন করে থাকে।

তারা সন্তানকে আগেভাগে গণিত শেখান

২০০৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বাবা-মা তাদের সন্তানকে আগেভাগে গণিত শিখিয়েছেন তারা ভবিষ্যতে বেশি সফলতা পেয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগেই যেসব শিশু সংখ্যা, ক্রম, ধাঁধাঁ, সাধারণ যোগ-বিয়োগ ইত্যাদি রপ্ত করেছে তারা শিক্ষা জীবনে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। ছোটবেলা থেকে গণিতে দক্ষ হলে তা ভবিষ্যৎ জীবনে ভাল প্রভাব রাখে, কারণ উচ্চতর শিক্ষায় গণিতের গুরুত্ব অপরিসীম।

সন্তানের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে

২০১৪ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, জন্মের প্রথম ৩ বছরে যেসকল সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তারা ৩০ বছর বয়সেও পড়ালেখায় ভাল করেছে।

কারণ ওই সময়টায় সন্তানের সাথে বাবা-মা বেশি বেশি সময় কাটালে তা সন্তানের মানসিক বিকাশকে উন্নত ও ত্বরানিত্ব করে। এই মানসিক বিকাশ ও উন্নতি সন্তানকে পরবর্তী জীবনে সফলতা অর্জন করার ক্ষেত্রে নিরব ভূমিকা পালন করে থাকে।

তারা কম চাপে থাকেন

সম্প্রতি একটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, শিশুর ৩-১১ বছর বয়স পর্যন্ত মা তাদের সাথে কয় ঘণ্টা করে সময় কাটায় তা শিশুর ভবিষ্যৎ স্বভাব, চরিত্র ও অর্জনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে থাকে। তবে অতিরিক্ত কড়া শাসন বা সবসময় সাথে লেগে থাকা আচরণ সন্তানের জন্য মঙ্গল তো নয়ই উল্টো হিতে-বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

মা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকলে, সন্তানের জন্য সময় বের করতে হিমশিম খেলে চাপে পড়ে যান। তার এই অস্থিরতা সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই বাবা-মা যদি চাপমুক্ত থাকেন, হাসি-খুশি থাকেন তাহলে তাদের সন্তানও ফুরফুরে থাকে। এবং মানসিকভাবে চনমনে থাকার ফলে তাদের পড়ালেখাসহ যাবতীয় কাজ সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে তারা জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারে।

তথ্যসূত্রঃ Parenting Guide