আমাদের শরীরে হাজারো ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাসের বসবাস। শিশুরদের ক্ষেত্রে তার বিস্তার আরো বেশি। শিশুদের মুখের ভেতর এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমণের ফলে সাদা পাতলা আস্তরণ দেখা যায়। এই রোগটির লক্ষণ, প্রতিকার আর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা রয়েছে এই নিবন্ধে।

শিশুদের মুখের ভেতর সাদা পাতলা পরতের যে আস্তরণ দেখা যায় সেটি আসলে কী?

এটিকে ক্যান্ডিডিয়াসিস বলে চিহ্নিত করা হয়। ক্যান্ডিডা নামক একপ্রকার ইষ্টের আক্রমণের ফলে এই রোগ দেখা যায়। এতে প্রধানত দুই ধরনের ফাঙ্গাস লক্ষ্য করা যায়।

১। মুখে ফাঙ্গাসের আক্রমণ (Oral candidiasis)। এক্ষেত্রে ছত্রাকের আক্রমণ দেখা যায় মুখের ভেতর, ঠোঁটে ও তার আশেপাশের অংশে।   

২। ডায়াপার অঞ্চলে আক্রমণঃ শিশুর জনন অঙ্গের আশেপাশে উষ্ণ ও ভেজা জায়গায় এর আক্রমণ দেখা যায়।

শিশুর মুখে ছত্রাকের সংক্রমণ? জেনে নিন প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে

শিশুর মুখে ছত্রাকের সংক্রমণ? জেনে নিন প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে

ফাঙ্গাস আক্রমণের কারণ

শিশু জন্মের সময় এই ইষ্টটি বায়ু থেকে সরাসরি শিশুর ত্বকের মাধ্যমে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে বা মায়ের কাছ থেকেও আসতে পার

১। মায়ের বা শিশুর এন্টিবায়োটিক সেবনের ফলে এই ব্যাকটেরিয়াটির উৎপত্তি হতে পারে।

২। শিশু দীর্ঘক্ষণ ভেজা ডায়াপার পরে থাকলে এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ দেখা দিতে পারে।

যেসব শিশু অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে

১। অপরিপক্ক শিশুরা কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। তাই সহজেই তারা এসব ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়।

২। এইচআইভি এইডস নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা।

৩। এজমা, হাঁপানির জন্য কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনে এর সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে।

৪। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের এই রোগ দেখা যায়।

৫। ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ফলে যেকোনো জীবাণু দ্বারা সহজেই সংক্রমিত হয়।

৬। মা যদি ইষ্ট দ্বারা মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমিত হয়ে থাকেন তবে মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে শিশুর মাঝেও তা সংক্রমিত হয়।

মুখে ফাঙ্গাসের সংক্রমণের লক্ষণ

১। ঠোঁট, জিহ্বা, মুখের ভেতরাংশে, তালুতে এমনকি গলদেশেও এই ফাঙ্গাসের আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। জেদি হলুদ বা সাদা বর্ণের এই আবরণ পানিতে ধুলে বা মুছলেও দূরীভূত হয় না।

২। শিশুর ঠোঁট ও জিহ্বা লালচে বর্ণ ধারণ করে।

৩। শিশু মাতৃদুগ্ধ পানে অনীহা প্রকাশ করতে পারে। শিশু অতিরিক্ত মাত্রায় কান্নাকাটি করে।

ডায়াপার অঞ্চলে সংক্রমণের লক্ষণ

১। ডায়াপার পরিহিত অঞ্চল ও জনন অঙ্গের বিভিন্ন ভাঁজে সংক্রমিত হয়। র‍্যাশের সাথে হলুদ পুঁজসহ ফুসকুড়ি লক্ষ্য করা যায়। ফোঁড়ায় ব্যাথা থাকে।

২। মুখে ছত্রাকের আক্রমণের সাথে ডায়াপার অঞ্চলের সংক্রমণের সম্পর্ক আছে। তাই এরূপ অবস্থা নজরে আসলে দেখুন মুখে ছত্রাকের আক্রমণ আছে কিনা।


ঘরোয়া পদ্ধতিতে ছত্রাক আক্রমণের প্রতিকার

১। প্রথমেই মাতৃদুগ্ধ পানের সময়সূচীতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিবার ২০ মিনিটের বেশি সময় ধরে দুধ পান করানো যাবে না।

২। শিশুকে ফিডারের পরিবর্তে চামচ, বাটি বা পাত্রে করে খাবার বা দুধ খাবার খেতে অভ্যস্ত করে তুলুন।

৩। তরল খাবারের প্রতি শিশুদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে চেষ্টা করতে করুন। বড় শিশুদের ক্ষেত্রে শক্ত খাবারের পাশাপাশি নরম বা অর্ধতরল খাবার যেমন জাউভাত,পায়েস ইত্যাদি গ্রহণে অভ্যস্ত করে তুলুন।

৪। দিনের কিছুটা সময় শিশুকে ডায়াপার ব্যবহার থেকে বিরত রাখুনএকাধারে অনেক সময় ধরে ডায়পার পড়িয়ে রাখবেন না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তা পরিবর্তন করে ফেলুন।

প্রতিকার ব্যবস্থা

১। এন্টিবায়োটিক সেবনে সচেতন হতে হবে মা ও শিশু দুইজনকেই। এন্টিবায়োটিক দীর্ঘমেয়াদী মাত্রায় সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হয়।

২। শিশুর প্লাস্টিকজাত খাবার পাত্র ও ফিডার জীবণুমুক্ত রাখতে হবে। প্রতিবার খাবার পর ফিডার ও অনুষাঙ্গিক পাত্র ফুটন্ত পানিতে ১০ মিনিট ধরে ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিন।

৩। ছত্রাক এক দেহ থেকে অন্য দেহে সংক্রমিত হয়। তাই এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি থেকে শিশুকে দূরে রাখুন। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ, চুমু ইত্যাদি থেকে সহজেই এই রোগ ছড়াতে পারে। এমনকি শিশুর খাবার পাত্র, নিপল, ফিডার এসব জিনিসও আক্রান্ত ব্যক্তি ছোঁয়ার মাধ্যমে ছড়াতে পারে এই রোগ।

৪। আক্রান্ত মায়ের থেকে খুব সহজেই শিশু এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত মায়ের স্তনের সংস্পর্শে আসলে শিশুরও হতে পারে এর সংক্রমণ। মায়ের সচেতনতা তাই খুব জরুরি। স্তনের আশেপাশে লালচে ভাব দেখা গেলে বা ফুলে গেলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সচরাচর যেসব প্রশ্ন করা হয়ে থাকে

১। ঘরোয়া পদ্ধতিতে প্রতিকার সম্ভব কি?

না। এক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। নারকেল তেল, বেকিং সোডা বা চিকিসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।

২। মুখের আক্রান্ত স্থানে দই ব্যবহার কতটা উপযোগী?

দইয়ের ল্যাক্টোব্যাসিলাস ছত্রাকের নিরাময়ে কিছুটা সাহায্য করতে পারে। কিন্ত তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে। সাথে অনুমোদিত ওষুধ তো থাকছেই।

৩। কীভাবে বুঝবো এটি ছত্রাকের আক্রমণ কিনা?

দুধ খাওয়ার জন্য শিশুদের জিহ্বায় সাদা আস্তরণ দেখা যায়। ভেজা কাপড় দিয়ে মুছলে তা আবার চলেও যায়। কিন্তু ছত্রাকের আক্রমণ হলে মুছে ফেলার পরেও তা অপরিবর্তনীয়

৪। শিশুদের থেকে কি বড়দের মাঝেও এটি সংক্রমণের আশংকা থাকে?শিশুর সাথে সার্বক্ষণিক যিনি থাকছেন তার মাঝে এই রোগের সংক্রমণ হতে পারে। এছাড়া শিশু থেকে মায়ের মাঝেও ছড়াতে পারে এই রোগ। এক্ষেত্রে শিশু প্রতিবার মায়ের দুধ খাওয়ার পর স্তন পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। কোমল পরিষ্কারক দ্রব্য অথবা ছত্রাকবিরোধী কোনো ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে তবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।

৫। সুস্থ হবার পরও যদি আবার ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দেয় তাহলে তখন পদক্ষেপ কী হবে?

শিশু বারবার এই রোগে আক্রান্ত হলে বুঝতে হবে তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশ নাজুক। ২ সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে চিকিৎসায় রোগ নিরাময়ের পরে আবারও এর প্রাদুর্ভাব ঘটলে শিশুকে নিয়ে আবারো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। এছাড়া অনেকসময় দেখা যায় শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরালো হয়। এমন রোগগুলোর সংক্রমণের হারও কমে আসে সাধারণভাবে।