পিতা হতে পারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের। আর এই সৌভাগ্য স্বর্গসুখে পরিণত হয় যদি সন্তানকে যথাযথভাবে মানুষ করা যায়।

সব বাবা চান সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত করতে। কিন্তু এই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করতে আমরা যা যা করি তার সব কি সঠিক সিদ্ধান্ত? পিতার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা ছোটো ছোটো ভুল করে বসি। এই ছোটো ছোটো ভুলগুলো শুধরে নিয়ে আপনাকে হয়ে উঠতে হবে সন্তানের পথপ্রদর্শক। আজকের নিবন্ধে এমন কিছু মনস্তাত্ত্বিক ও বিশেষ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যা পিতা হিসেবে সফল হতে হলে অবশ্যই আপনার মধ্যে থাকতে হবে। এই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো চর্চা করলে নিশ্চয়ই আপনি সন্তানের প্রথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে সক্ষম হবেন।

বাবা হিসেবে হয়ে উঠুন সন্তানের পথপ্রদর্শক

বাবা হিসেবে হয়ে উঠুন সন্তানের পথপ্রদর্শক

১. সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলুন

অনেক পিতা সন্তানকে সব সময় শাসন করতে পছন্দ করেন। সন্তানের সাথে সব সময় কঠিন আচরণ করেন এবং মনে করেন, তিনি যেমন চান, সন্তান ঠিক তেমন হয়ে উঠবে। এই ধ্যান-ধারণা বহু পুরনো। আপনাকে এমন মানসিক অবস্থা থেকে বের হতে হবে। নিজেকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আপডেট করতে হবে। বুঝতে হবে সন্তানকে জোর করে নিজের মতো করা যায় না। তাছাড়া, সন্তান যদি সবকিছু আপনার মত করে চিন্তা করবে, তাহলে সে এখনো শিশু কেন? তাদের সকল বিষয়ে পরিপক্ক হয়ে উঠতে যথেষ্ট সময় লাগে। সুতরাং এই সময়ের জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। সুতরাং তাদের উপদেশ দেওয়া বন্ধ করুন এবং খেলার ছলে সবকিছু শিখিয়ে দিন। অনেক পিতা সন্তানকে নানান মিথ্যা প্রলোভন দেখান এবং সেই প্রলোভন বাস্তবায়ন করতে উপদেশ দেন। সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আপনাকে এই ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে হবে। সন্তানকে সবসময় নতুন শিশু হিসেবে দেখুন। ভুলেও তাকে আপনার চোখ দিয়ে দেখবেন না, অর্থাৎ আপনি তাকে যেমন দেখতে চান, তেমন করে ভাববেন না।

২. মেয়ে সন্তানের সাথে বাইরে সময় কাটান

প্রকৃতিগতভাবে পিতারা মেয়ে সন্তানের ব্যাপারে রক্ষণশীল হয়ে থাকে। ছেলে সন্তানের চেয়ে মেয়ে সন্তানের ব্যাপারে বেশি যত্নশীল হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাড়ির বাইরে বের হওয়া, অন্যদের সাথে মেশা এবং খেলাধুলো করার ব্যাপারে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, মেয়ে সন্তানের ব্যাপারে রক্ষণশীল হয়ে তাকে দেবীর মত সুরক্ষিত অবস্থায় পূজা করা বা রাজকুমারীর মত নিরাপত্তা দেওয়া উচিত নয়। মেয়ে সন্তানের ব্যাপারে বিশেষ যত্নের প্রয়োজন আছে সত্যি। কিন্তু তাই বলে তাকে বাক্সবন্দী করে রাখলে চলবে না। ছেলে সন্তানের মতো মেয়ে সন্তানের সাথেও খেলাধুলা করুন, তাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যান। বিভিন্ন পরিবেশের সাথে মানানসই করে তুলুন। বাইরের পরিবেশ ও মিথস্ক্রিয়তা তাকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী এবং স্বাধীন হতে সহযোগিতা করবে।

৩. সাধারণ হয়ে উঠুন

প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়াকালীন অসংখ্য ছেলে মেয়ে নিজের বাবাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। বন্ধুদের সাথে নিজের বাবাকে নিয়ে বলে, আমার বাবা তোমার বাবার চেয়ে অনেক বড় ও ধনী। শিশুরা নিজের বাবাকে সুপারম্যানের মতো মহান ভাবতে শুরু করে। কিন্তু শিশুদের এই বয়সটা খুব দ্রুত পাল্টে যায়। তারা শৈশব থেকে কৈশোরে উপনীত হয় এবং এতদিন ধরে যে বাবাকে সুপারম্যান জ্ঞান করে এসেছে, তাকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু শিশুদের এই বাড়ন্ত বয়সে যদি পিতা হিসেবে আপনি সন্তানকে ভুল পরামর্শ দেন, তাহলে পস্তাবেন। এই বয়সী শিশুদের সামনে নিজেকে যতটা সম্ভব সাধারণভাবে উপস্থাপন করুন। তাদের সামনে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করুন, যেন তারা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। আপনাকে দেখে চমৎকৃত হওয়ার চেয়ে আপনার কথায় যেন তারা বেশি মনোযোগী হয়। তাই সব সময় শিশু সন্তানকে সৎ পরামর্শ দিন এবং নিজেকে যতটা সম্ভব সাধারণভাবে উপস্থাপন করুন।

৪. সন্তানকে হাতে একটি কম্পাস এবং একটি মানচিত্র দিন

আপনার সন্তান একদিন বড় হয়ে স্বাধীন মানুষে পরিণত হবে। এটা ভেবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সে-সময় আপনি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবেন না, বরং আপনি আরো কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপক পর্যায়ে উন্নীত হয়ে পেছনের সিটে বসবেন। কিন্তু এই পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য আপনাকে বিশেষ কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। সন্তানকে যথাযথভাবে মানুষ করতে হবে। আপনার সন্তান যেন বড় হয়ে নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার জন্য আপনাকে ২টি কাজ করতে হবে।

প্রথমত, আপনার সন্তানকে মূল্যবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, সততা এবং শ্রদ্ধাবোধের সংমিশ্রণে এমন ইতিবাচকভাবে গড়ে তুলুন যেন তার এই বৈশিষ্ট্যগুলো নৈতিকতার কম্পাস হিসেবে কাজ করে। যেন সে সঠিক এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রয়োজনে সন্তানকে আপনার জীবনের গল্প এমনভাবে শোনান, যেন তা সন্তানের জন্য একটি মানচিত্রের মতো কাজ করে। যে মানচিত্র তাকে পথপ্রদর্শকের মত পথ চিনিয়ে জীবনের সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে সন্তান কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, যখন সে পথ হারিয়ে ফেলবে, আপনার সংগ্রামী জীবনের গল্প ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে পথের দিশা দেবে।

সুতরাং, আপনার সংগ্রামী জীবনের গল্প নিজের মুখে সন্তানকে শোনান এবং তাকে বলিষ্ঠ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন।

সন্তানকে আরো আপন করে নিতে বাবা দিবস আপনার জন্য একটি বিশেষ দিন হতে পারে। বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ এই দিনে নিজের পিতৃত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। সুতরাং আপনিও এই দিনে সন্তানকে আরো গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করুন এবং তার ভবিষ্যৎ জীবন নির্বিঘ্ন করতে নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।